Wednesday, May 20, 2015

এলোমেলো লেখার খাতা Part-1



   আমি বেশ কিছুদিন যাবত এক অদ্ভুত কঠিন সমস্যায় পরেছি। কিছুই খেতে ইচ্ছা করে না। পেটে প্রচণ্ড ক্ষুধা, কিন্তু মুখে রুচি নেই। রাস্তার মোড়ে KFC’র বিজ্ঞাপনের ফ্রাইড চিকেন দেখলেই জিভে জল এসে যায়। কিন্তু সেই ফ্রাইড চিকেন খেতে গেলে, কয়েক লোকমা খাওয়ার পর আর খেতে ইচ্ছা করে না। অথচ পেটে প্রচণ্ড ক্ষুধা, খাবারের গন্ধ নাকে গেলেই চোখ স্বয়ংকৃত ভাবে খাবারের দিকে চলে যায়। কেউ মজা করে পিজ্জা, বার্গার খাচ্ছে দেখলেই আর চোখ সরাতে পারি না। কিন্তু কোনকিছু মুখে দিলেই আর গিলতে ইচ্ছা করে না, অথচ পেটে প্রচণ্ড ক্ষুধা।
    শুনেছি পেটে ক্ষুধা নিয়ে নাকি কোন মহান শিল্পকর্ম করা যায় না। কবির ভাষায়, ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়। অর্থাৎ সেখানে পদ্য বা কবিতা অনুপস্থিত। মহান শিল্পকর্ম বলতে জ্ঞানীরা কবিতাই বুঝিয়ে থাকেন। জদিও আমার মত চুন-পুটি মার্কা লোকের এইসব উচ্চ শ্রেণীর বিষয় নিয়ে নাড়াচাড়া করা উচিৎ হচ্ছে না। কারন এতে সাহিত্যের নুরে, আমার মত পাপির দেহ ভস্য হয়ে যাওয়ার এক ভয়াবহ সম্ভাবনা রয়েছে।
    আমার কিছু জ্ঞ্যান বোদ্ধা, উচ্চ শ্রেণীর সাহিত্যিক বন্ধুদের মতে, যে কবিতা বোঝেনা তার সভ্য সমাজে বাস করার অধিকার নেই। তাদের জাহাজে করে, নাম পরিচয়হীন কোন অজানা দ্বীপে ফেলে দিয়ে আসা উচিৎ। আমার এক রকার কবি বন্ধু (মোঃ ইয়াকুব আলী) এক সময়, চাঁদনী রাত, নদীর ঘাট, বাঁশ বাগান ইত্যাদি নিয়ে রকিং কবিতা লিখত। সে কবিতা লিখে বন্ধু মহলে একপ্রকার হই-চই ফেলে দিয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ করে তার অনুপ্রেরণার চাবি কাঠি বেহাত হয়ে যাওয়ায় সে কবি জীবন থেকে পালিয়ে যায়। তখন সে বলে বেড়াত, কবিতা লেখা বোকাদের কাজ, যাদের খেয়েদেয়ে কাজ নেই, তারাই কবিতা নিয়ে মাতামাতি করে। এই পাপেই কি সে কবিতা হতে নির্বাসিত? তাহলে আমার কি হবে? আমার কলম দিয়েত কবিতার ‘ক’ও বের হয় না। তাহলে আমিও কি সভ্য জগত হতে নির্বাসিত হব?
    আরে তাইত, দুই বছরের বেশি হতে চলল, আমি আমার চেনা জানা জগতের বাইরে। সম্পুর্ন ভিন্ন এক দেশে, ভিন্ন ভিন্ন সাংস্ক্রিতির ভিরে নির্বাসিত বঙ্গ সন্তান। উদ্দেশ্য সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং এ ডিগ্রী নেয়া। ডিগ্রী নিয়ে দেশে ফিরব, দেশ ও জাতীর মুখ উজ্জ্বল হবে। সেই আশায় জাতী অধীর আগ্রহে বসে আছে। এসব ভাবতেই শরীরের লোম দাঁড়িয়ে যায়। কিন্তু সমস্যা অন্য যায়গায়। পেটে প্রচণ্ড ক্ষুধা কিন্তু মুখে রুচি নেই।
    সে যাই হোক, রোগ থাকলে তার চিকিৎসাও থাকবে। হয়ত কিছু কিছু রোগের চিকিৎসা পদ্ধতি এখনও অজানা, তার মানে এই না যে ভবিষ্যতে এর চিকিৎসা পদ্ধতি বের হবে না। মোবাইলে, স্কাইপে আম্মার রাগারাগিতে দিশেহারা হয়ে বের হলাম একদিন চিকিৎসকের সন্ধানে। আম্মার রাগারাগির যথেষ্ট পরিমান কারন আছে। যে কোন রোগ প্রাথমিক অবস্থাতেই নিরাময় করা উচিৎ। তাছাড়া রোগ বোয়েবেরিয়ে কষ্ট করার মানে হয় না। তাই ইউনিভার্সিটির মেডিক্যাল ইন্সুরেন্সের ভরসা না করে নিজেই এক প্রাইভেট ডাক্তারের খোঁজ করলাম।
    এখানে বলে রাখা ভাল, ইউনিভার্সিটির প্রত্যেক সেমিস্টারের শুরুতে মেডিক্যাল ইন্সুরেন্স বাবদ একগাদা টাকা দিতে হয়। মেডিক্যাল ইন্সুরেন্স গালভরা নাম হলে কি হবে, কাজে তেমন সুবিধার না। কারন এই ইন্সুরেন্সের মাধ্যমে শুধু জ্বর, মাথাব্যাথার ওষুধ ছাত্রদের সংগ্রহ করতে দেখেছি। কিন্তু মেজর কোন হেলথ ডিজিজে এই ইন্সুরেন্স কতটুকু কার্জকরি তা সকলেরই অজানা। আবার অনেক দেশের ছাত্র-ছাত্রীরা এই ইন্সুরেন্স কোনদিন কাজেও লাগায় না। তাদের এম্বাসির হেলথ ডিপার্টমেন্ট তাদের চিকিৎসার ব্যায় ভার বহন করেযেমন ওমানিজ, ইন্দোনেশিয়ান এম্বাসি তাদের দেশের ছাত্র-ছাত্রীদের বিশেষ যত্নে রাখে। আর আমাদের দেশের এম্বাসির হর্তা কর্তারা বিদেশি কূটনৈতিকদের সাথে স্বস্ত্রীক ডিনার খাওয়ার মত গুরুত্ব পুর্ন কাজে ব্যাস্ত থাকেন। তাদের এত সময় কোথায় ছাত্র-ছাত্রীদের খোঁজ খবর করার। যাদের কাছে হুমায়ূন আহমেদের মত লেখক কোন বেইল পায় না, সেখানে আমরা কোন প্রানী।
    এর পর আবার আছে ইউনিভার্সিটির ইন্সুরেন্স পলিসি। আমি যতদূর জানি, ইউনিভার্সিটির পলিসি অনুযায়ী 20000 AUD পর্জন্ত চিকিৎসা ব্যায় বহন করার কথা। কিন্তু প্রাথমিক অবস্থায় এই ব্যায় ছাত্রকেই বহন করতে হবে। তারপর ইউনিভার্সিটি চিকিৎসা ব্যায়ের সমপরিমাণ টাকা রিফান্ড করবে। কিন্তু এই সমস্ত প্রসেসের মধ্যদিয়ে যেতে কত সময় লাগতে পারে তা অনুমান করা আমার মত স্বল্প বুদ্ধির হাভাতে বাঙ্গালীর পক্ষে সম্ভব নয়। তাই চুলোয় যাক মেডিক্যাল ইন্সুরেন্স বলে রাস্তায় নেমে পরলাম।
    আমাদের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টের এক রাশিয়ান ছেলে, আশকার জাক্সিলাইকভ (Askar Zhaxylykov) আমাকে পরামর্শ দিল, কেনি হিলস সাইটে বেশ কয়েকটি প্রাইভেট ক্লিনিক রয়েছে। অতপর কেনি হিলস সাইটেই যাওয়া স্থির করলাম।
    কেনি হিলস কমার্শিয়াল এরিয়া হওয়ায়, সবসময় হই হট্টগোল লেগেই আছে। এরিমদ্ধ্যে খুঁজেপেতে বেশ কয়েকটি প্রাইভেট ক্লিনিক পাওয়া গেল। বেশি বাছবিচার না করে প্রথমটিতেই ঢুকে পরলাম। রিসিপ্সনে অল্পবয়সী সুন্দরী এক চাইনিজ নার্স বসা ছিল। তার কাছে সমস্যার কথা বলতেই সে সুন্দরকরে হেসে, পেশেন্ট প্রোফাইল তৈরি করা শুরু করল। প্রোফাইল তৈরি শেষে আমার হাতে একটি টোকেন ধরিয়ে দিয়ে অপেক্ষা করতে বলল। টোকেনে লেখা 31 বর্তমানে 19 চলছে। বাহ দুটোই প্রাইম সংখ্যা।
    অপেক্ষা করার জন্ত্রনার কথা মনে হওয়ায়, প্রাইম সংখ্যা বেশিক্ষণ আমাকে অভিভূত করে রাখতে পারল না। নার্সটিকে জিজ্ঞ্যাসা করলাম আনুমানিক কতক্ষণ অপেক্ষা করতে হতে পারে। কারন দুপুরের পর লেকচার থিয়েটারে Bio-Mimicry এর উপর একটি লেকচার সেমিনার আছে। সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং ক্লাব ও ইঞ্জিনিয়ার্স অস্ট্রেলিয়া এ্যাসোসিয়েশন যৌথ উদ্যোগে এই সেমিনারের আয়োজন করেছে।
    সেমিনারের প্রধান বক্তা অ্যারিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটির Dr. Deborah Bergin. উনি “Genius of Place Research for Middle Kyle Canyon” প্রজেক্টের প্রোজেক্ট ম্যানেজার ছিলেন। সেমিনারে উনি তার গবেষণা পত্র পাঠ করবেন, এছারাও এঞ্জিনিয়ারিং ক্ষেত্রে Bio-mimicry’র ব্যাবহার কিভাবে সম্প্রসারিত করা যায় সেই বিষয়ে আলোচনা করবেন। আমাদের Sustainable Design কোর্সে Bio-Mimicry সম্পর্কে একটু ধারনা দেয়া হয়েছিল। তখনি বিষয়টা আমার কাছে যথেষ্ট পরিমান ইন্টারেস্টিং মনে হয়েছে। জদিও Bio-Mimicry আমার মেন্ডেটরি সাবজেক্ট না, এছারাও এ বিষয়ে আমাদের এই ক্যাম্পাসে কোন কোর্স অফার করে কিনা তা আমার জানা নেই। তবুও এই লেকচার সেমিনারে উপস্থিত থাকার জোর তাগিদ অনুভব করলাম।
    ইনভাইটেশন ই-মেইল হতে যতটুকু ধারনা করতে পারছি, আমাদের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টের কোর্স কো-অর্ডিনেটর Dr. Ling Tong Wei, ওয়াটার রিসর্স বিভাগের Dr. Dominic wong এবং রিসার্স ল্যাব্রেটরির Dr. Joanne এই বিষয়ে আগ্রহী। কারন Bio-Mimicry হচ্ছে ইঞ্জিনিয়ারিঙের সেই শাখা, যেখানে প্রকৃতি হতে জ্ঞান আহরন করে তা বাস্তব ক্ষেত্রে কাজে লাগান হয়। তাই এতে গবেষণার জন্য অবারিত দার খোলা। প্রকৃতি ও বিজ্ঞ্যানের এই শাখাটি অনেক প্রাচীন হলেও সম্পুর্ন অজানা কারনে মানব ইতিহাসের মাঝের কয়েক হাজার বছর এর কোন চর্চা হয়নি। কিন্তু সেই প্রাচীন মিশরিয় ফারাওদের আমলে এর ব্যাপক প্রচলন ছিল তার বহু প্রমান আছে, বিশেষ করে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং ক্ষেত্রে। অতএব এই সেমিনারে যোগ না দিলে বোকামি করা হবে।
    সে যাই হোক, নার্সটি আমার প্রশ্নের উত্তরে জানাল তাদের ক্লিনিকে দিনে একজন মাত্র ডাক্তার থাকেন। এ কথা শুনে আমার হতাশ হওয়া উচিৎ না রাগ করা উচিৎ তা বুঝে উঠতে পারলাম না। এই মুহুর্তে অপেক্ষা করা ছারা আর কিছু করার নেই।
    অতপর ডাক্তারের চেম্বারে ডাক পরল। ভিতরে প্রবেশ করে দেখি ৬০ উর্ধ এক বৃদ্ধ ব্রিটিশ ডাক্তার বসে আছে। লোকটি বৃদ্ধ হলেও তার চোখগুল প্রাণবন্ত। ডাক্তারটি হেসে বলল, তাহলে তোমার নাম “মিনুল ইসলাম” (আমার নাম বাংলায় মাইনুল ইসলাম, ইংরেজি “Minul Islam” যে যার ইচ্ছামত উচ্চারন করে। আমিও এনিয়ে মাথা ঘামাই না। কারন আমি এমন কেউ না যে, আমার নাম সুদ্ধ করে না বললে মহাভারত অশুদ্ধ হবে।) সে কিছুক্ষন পেশেন্ট প্রোফাইল দেখে, হঠাট আমার দিকে তাকাল। কিন্তু কিছুই বলল না। তার পর কিছু রেগুলার চেক-আপ চলল। চেকাপ শেষে বলল,
তোমার রাতে ঘুম হয়
জি হয়, রাতে ঘুমাতে কিছুটা দেরি হলেও ভালই ঘুম হয়।
তুমি কি কিছু কিছু বিষয় নিয়ে খুব ভাবনা কর?
আমি অবাক হয়ে ভাবলাম, পেটের সমস্যার সাথে চিন্তা-ভাবনার কি সম্পর্ক।
তোমার পেটে ব্যাথা, ক্ষুধামন্দা এসব কোন শারিরিক সমস্যার জন্য হয়নি। তোমার শরীর সম্পুর্ন সুস্থ।
মানে?
তোমার বর্তমান সমস্যা গুল হয়েছে মানসিক অস্থিরতা থেকে। কোন কারনে মন বিক্ষিপ্ত থাকলে, মস্তিষ্কের শরীর বৃত্তিয় কাজে গণ্ডগোল দেখা দেয়। ফলশ্রুতিতে হয় বদহজম, পেটেব্যাথা, ক্ষুধামন্দা।
ঠিক তেমনি বেশি খেলে রাতের বেলা দুঃস্বপ্ন দেখার সম্ভাবনা থাকে। অর্থাৎ শরীর মন একে অপরের পরিপূরক। একজনের সিস্টেমে সামান্য গণ্ডগোল হলে, অন্যজনের সিস্টেমেও গণ্ডগোল দেখাদেয়।
যেহেতু তুমি স্টুডেন্ট এবং ফ্যামিলি থেকে অনেকদিন হল বাইরে আছ। স্ট্যাডি ডিপ্রেশন ও ফ্যামিলি নিয়ে টেনশন থেকে থেকে এসব হওয়া স্বাভাবিক। বেশি টেনশন না করে লেখাপড়া মনোযোগ দিয়ে কর। আর তুমি এতদুর থেকে ফ্যামিলি নিয়ে টেনশন করে, তাদের কোন উপকার করতে পারবে না। তাই টেনশন মুক্ত থাকার চেষ্টা কর।
কিছু ওষুধ দিয়ে দিচ্ছি, ঠিকমত ওষুধ খেলে আর টেনশন মুক্ত থাকতে পারলে কিছুদিনের মধ্যে তোমার সমস্যা ঠিক হয়ে যাবে।
    ডাক্তারের চেম্বার থেকে বের হতেই, সেই সুন্দরী রিসেপশনিস্ট নার্সটি বলল, একটু অপেক্ষা কর তোমার ওষুধ এনে দিচ্ছি।
    আমি মনে মনে হিসাব করা সুরু করলাম, ডাক্তারের ফি প্লাস ওষুধ সব মিলিয়ে কতটাকা বিল আসতে পারে।
    এইসময় নার্সটির ডাকে হিসাবে গণ্ডগোল হয়ে গেল। সে ওষুধ খাবার নিয়ম গুল ভালভাবে বুঝিয়ে দিয়ে প্যাকেট করে দিল।
    আমি বিলের কথা বলতে সে বলল, তোমাকে দেখে বিদেশি মনে হচ্ছে। তোমার কি কোন মেডিক্যাল ইন্সুরেন্স আছে?
হ্যা, আমার ইউনিভার্সিটির মেডিক্যাল ইন্সুরেন্স করা আছে।
কোন সমস্যা নেই, ওতেই চলবে। তোমার মেডিক্যাল ইন্সুরেন্স কার্ড আর ইউনিভার্সিটির আইডেন্টি কার্ড দাও।
আমি মনে মনে বেজায় খুশি, যাক অবশেষে মেডিক্যাল ইন্সুরেন্স কিছুটা হলেও কাজে লাগল।


মোঃ মাইনুল ইসলাম রনী
২০/০৫/২০১৫

No comments:

Post a Comment